২৭৪ মিনিট আগের আপডেট; দিন ১:২৪; শনিবার ; ১৯ এপ্রিল ২০২৪

অদৃশ্য কারণে উচ্ছেদ হচ্ছে না সৈকতের ‘চিয়ার্স বিচফ্রন্ট ক্যাফে’

এম.এ আজিজ রাসেল ২২ অক্টোবর ২০২০, ১৩:০৩

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) স্থাপিত সকল স্থাপনা সরাতে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। আদালতের রায় অমান্য করে নিত্য নতুন গড়ে উঠছে অবৈধ  স্থাপনা। সম্প্রতি সরকারি জমিতে তরঙ্গ রেস্তোরাঁর কর্তৃপক্ষ ‘চিয়ার্স বিচফ্রন্ট ক্যাফে’ নামে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করছে। স্থাপনা নির্মাণ না করতে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের আলোকে সাইন বোর্ড স্থাপন করেন জেলা প্রশাসক।

কিন্তু আদালতের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জেলা প্রশাসন কর্তৃক স্থাপন করা সাইনবোর্ড গুড়িয়ে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে তরঙ্গ রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে ওই স্থানে ‘চিয়ার্স বিচফ্রন্ট ক্যাফে’ এর সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তরঙ্গ’র অবৈধ এই স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, পরিবেশপ্রেমীসহ সুশীল মহলের নেতৃবৃন্দ। সুশীল মহল মতে, সৈকতে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) সব প্লট বাতিল করা হয়। সেখানে কোন রকম স্থাপনা নির্মাণ না করতে আদেশ দেন মহামান্য হাইকোর্ট।

ইতোমধ্যে ওই আদেশের আলোকে সুগন্ধা পয়েন্টে ৫২টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেন জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। সুগন্ধা পয়েন্টে অবৈধ স্থাপনা একপাশ দিয়ে উচ্ছেদ করলেও প্রতিরাতে অন্যপাশে দখল করে স্থাপনা গড়ে তুলছেন প্রভাবশালীরা। এখনো সৈকত এলাকায় ড্রাগন মার্কেট, সী-ইন মার্কেট, হাড়ি রেস্তোরাঁ ও তরঙ্গ রেস্তোরাঁ বহাল তবিয়তে রয়েছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ‘চুনোপুটিদের স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও রাঘব বোয়ালদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি। তাদের সাথে বিভিন্ন পদস্থ কর্তা ও কতিপয় সাংবাদিকদের সাথে দহরম মহরম সম্পর্ক। সৈকতে নানা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও পরবর্তীতে ফের দখল করা হয় সরকারি জায়গা।’ 

‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ সামাজিক সংগঠনের সমন্বয়ক কলিম উল্লাহ বলেন, ‘মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্টের আদেশ মোতাবেক সমুদ্র সৈকতের সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হোক। প্রয়োজনে উচ্ছেদ কার্যক্রমকে তরান্বিত করতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বরাদ্দ দেয়া হোক।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু ঝুপড়ি উচ্ছেদ করে দায়মুক্ত হওয়া যাবে না। বিশে^র এই বৃহৎ সৈকতের সৌন্দর্য্য রক্ষায় বাতিলকৃত প্লটে অবৈধ স্থাপনা ও দখলকারীদের সরিয়ে উচ্চ আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করা হোক।’

এনভায়রনমেন্ট পিপল এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় (ইসিএ) স্থাপিত সকল স্থাপনা সরাতে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এসব উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। এর উপর নতুন নতুন অবৈধ  স্থাপনা তৈরী হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পাশাপাশি নতুন করে যাতে কোন স্থাপনা গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফলোআপ থাকা উচিত।

এ ব্যাপারে সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. শাহরিয়ার মুক্তার বলেন, ‘তরঙ্গ কর্তৃপক্ষ তাদের কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। যাচাই বাছাই করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। রায়ের কোন কপি তারা দেননি।’

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, সৈকতে বাতিলকৃত প্লটে কোন রকম অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কেউ আদালত ও জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা না মানলে তড়িৎ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকারি সম্পদ রক্ষায় জেলা প্রশাসন বদ্ধপরিকর। 

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সৈকতের বাতিলকৃত ১০নং প্লট দখল করে রেখেছে তরঙ্গ রেস্তোঁরা কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে ওই স্থানে ‘চিয়ার্স বিচফ্রন্ট ক্যাফে’র নাম দিয়ে নির্মিত হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। দিন-রাত ২০-২৫ জন শ্রমিক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। স্থাপনা নির্মাণ না করতে দুইবার বিচকর্মী পাঠিয়ে তাদের নিষেধ করেন সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. শাহরিয়ার মুক্তার। কিন্তু তারা তাতে কোনরকম কর্ণপাত করেনি। এর আগে তরঙ্গ রেস্তোঁরার কর্মচারিদের জন্য নির্মাণ করাও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। তৎকালীন সহকারি কমিশনার (ভূমি) মো. নাজিম উদ্দিন তরঙ্গ রেস্তোঁরা থেকে উদ্ধার করেছিল বিপুল পরিমাণ ঝাউগাছ। এ জন্য জরিমানও গুণতে হয় কর্তৃপক্ষকে।

গত মঙ্গলবার (২০ অক্টোবর) এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে তরঙ্গ রেস্তোরাঁর ৭-৮ জন কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে নাজেহাল করার চেষ্টা করা হয়। কর্মকর্তারা দাপটের সাথে বলেন, ‘কক্সবাজারের প্রায় সাংবাদিক আমরা মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে রেখেছি। এখানে প্রতিদিন ডিসি-এডিসি চা-নাস্তা খেতে আসে। সেখানে তোমার মতো প্রতিবেদক আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’ এসময় তরঙ্গ রেস্তোরাঁর ওই ৭-৮ জন কর্মকর্তা প্রতিবেদকের ভিডিও ধারণ করে ভয়ভীতি  ও নানা হুমকী দেন। 

সুত্রে জানা যায়, সৈকতের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় শর্ত সাপেক্ষে সরকার কিছু প্রতিষ্ঠানকে প্লট লিজ দেয়। কিন্তু সরকারের বেধে দেয়া শর্ত ভঙ্গ করায় প্লটসমূহ বাতিল করা হয়। তারমধ্যে তরঙ্গ রেস্তোরাঁর ১০নং প্লটও বাতিল করা হয়। বাতিলের পর তরঙ্গ কর্তৃপক্ষ সরকারের মামলার (বন্দোবস্ত মামলা নং-৯(ক)/৯৩-৯৪) বিপরীতে মহামান্য হাইকোর্টে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দাখিল করে। কিন্তু মহামান্য হাইকোর্ট তাদের মামলা খারিজ করে দিয়ে বাতিলকৃত প্লটে কোন রকম স্থাপনা নির্মাণ না করার জন্য আদেশ দেন।

সেই আদেশের বিপরীতে আরও ২ বার আপীল করে তরঙ্গ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রতিবারই আপীল খারিজ করে দেন মহামান্য হাইকোর্ট। সর্বশেষ মহামান্য সুপ্রীমকোর্টও ২০১৯ সালের মার্চে তরঙ্গ কর্তৃপক্ষের মামলা খারিজ করে দেন বলে তথ্যসূত্রে জানা গেছে। কিন্তু বর্তমানে তরঙ্গ কর্তৃপক্ষ তাদের পক্ষে রায় দেয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদকে বলা হয়। তরঙ্গ কর্তৃপক্ষ জানান, সরকারের মামলার বিপরীতে আমাদের পক্ষে রায় দেয়া হয়। তাই আর এখানে স্থাপনা নির্মাণে বাধা নেই।

রায়ের কপি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে গেলে সব জানা যাবে। তবে তরঙ্গ রেস্তোরাঁর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাদের পক্ষে রায় দেয়া হলে রায়ের কপি বাইপোস্টে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌছানো হতো। কিন্তু সেখানে রায়ের কপি দেয়া হয়নি। তরঙ্গ কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের একজন অ্যাডভোকেট এর মাধ্যমে বানোয়াট কাগজপত্র তৈরি করে সবার চোখে ধুলো দিয়ে যাচ্ছে।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তরঙ্গ রেস্তোঁরার মালিক মালিহা কিশোর ও ম্যানেজার মো. ফয়েজ দম্ভোক্তির সাথে বলেন, ‘এখানে স্থাপনা নির্মাণে আমাদের হাইকোর্টের অনুমোদনের রায়ের কপি রয়েছে। অনেক সাংবাদিক ও প্রশাসনের কর্তা আমাদের হাতের মুঠোয়। আপনাদের সাংবাদিকতার আইডি কার্ড নিয়ে আসেন তারপর কথা বলবো। বেশি কথা বললে চাঁদাবাজির দায়ে থানায় ভূঁয়া অভিযোগ দিব।’