৮৩৪ মিনিট আগের আপডেট; রাত ১:১৭; বৃহস্পতিবার ; ১৭ এপ্রিল ২০২৪

আমরা খেলার মাঠের খেলা দেখতে চাই, দেখতে চাইনা রাতের আঁধারের ক্যাসিনো বা জুয়া খেলা

মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী ১৯ অক্টোবর ২০১৯, ২২:৪৫

টক অব দা কান্ট্রি হচ্ছে ক্যাসিনো মানে জুয়া খেলা। পাশাপাশি র‍্যাব এবং পুলিশের অভিযানে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ, ডলার,  স্বর্ণালংকার, বিদেশি মদ, ক্যাসিনো খেলার সামগ্রী আটক হচ্ছে দেশ এখন টাল মাটাল হয়ে উঠেছে। রাজধানীতে জুয়ার আসর বসার কথা শোনা গেলেও আধুনিক ক্যাসিনোর অস্তিত্ব থাকার খবর একেবারেই নতুন।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর’১৯ রাতে র‍্যাব রাজধানীর গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা ক্রীটকড়া চক্র, ফকিরাপুলের ইয়াংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স এবং বনানীর গোল্ডেন ঢাকা ক্লাবের জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়ে রাতে সেগুলো সিলগালা করে দেয় র‍্যাব। চারটি ক্যাসিনো থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ মদ, বিয়ার, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা ১৮২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়।

অপরদিকে ২০ সেপ্টেম্বর’১৯ সন্ধ্যায় কলাবাগান ক্রীড়া চক্র ও ধানমণ্ডি ক্লাবে অভিযান চালায় র‍্যাব। কলাবাগান ক্লাব থেকে অস্ত্র, ইয়াবা বড়ি, ক্যাসিনো খেলার কয়েন এবং ৫৭২টি প্লেয়িং কার্ড সেট উদ্ধার করেছে র‍্যাব। তবে দেশবাসীকে বিস্মিত হতবাক এবং বিরাট ধাক্কা দিয়েছে ছয় জন দেহরক্ষী নিয়ে গডফাদারের মতো চলাফেরা করা মহাক্ষমতাধর  ব্যক্তি এস এম কিবরিয়া ওরফে শামীমের বিলাসবহুল অফিসে র‍্যাবের অভিযানের পর।

তিনি নিজের নাম সংক্ষেপ করে বলতেন জি কে শামীম, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সের মালিক তিনি। নিজেকে পরিচয় দিতেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বলে। তাঁকে এবং তাঁর সাত দেহরক্ষীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি সেখান থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) নথি যেখনে তাঁর মায়ের নামে রয়েছে ১৪০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের নথি, ৯ হাজার ইউ এস ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, একটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং মদের বোতল জব্দ করা হয়। র‍্যাব সূত্র জানায়,‘কলাবাগান ক্লাবই প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ক্যাসিনো চালুর উদ্যোগ নেয়।

কলাবাগান ক্লাবের আদলে প্রথমে ভিক্টোরিয়া ও পরে একে একে ওয়ান্ডারার্স, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা, মোহামেডান, আরামবাগে স্লট মেশিন বসে’ । আরও জানা যায়, ক্লাবাগানে স্লট মেশিন জুয়ার জন্য আন্তর্জাতিক মানের বোর্ড, নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী পুরুষ আনা হয়। এখানেই শেষ নয়, গত ২৪ সেপ্টেম্বর’১৯ ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অংশীদার রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এবং তাঁর ছোট ভাই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভুঁইয়ার ব্যবসা বলতে ছিল ক্যাসিনো এবং তাঁদের বাড়ির সিন্দুক থেকে উদ্ধার করে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা এবং চার কোটি টকা মূল্যের স্বর্ণালংকার।

এই দুই ভাইয়ের সিন্দুক ভরে যাওয়ার পর তাঁরা টাকা এবং স্বর্ণালংকার রাখনে ক্যাসিনো কর্মচারী আবুল কালাম এবং বন্ধু হারুণের বাসায়ও। র‍্যাবের অভিযানে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় টাকা, স্বর্ণালংকার এবং অস্ত্র। সব মিলিয়ে এই অভিযান থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচ কোটি পাঁচ লাখ টাকা, চার কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও ছয়টি অস্ত্র যদিও অভিযানে কেউ ধরা পড়েননি । শুধু ক্লাব পাড়ায় এই অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা সীমাবদ্ধ নেই। ‘ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাটবাড়িতেও অবৈধ ক্যাসিনো চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও যুব লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এমন ২১টি ক্যাসিনোর বিষয়ে তথ্য পেয়েছে র‍্যাব’ ।   

এক তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮ সেপ্টেম্বর’১৯ গ্রেপ্তার অভিযান শুরুর পর থেকে গত ২৮ সেপ্টেম্বর’১৯ পর্যন্ত ১১ দিনের অভিযানে ১০ ক্লাবে ক্যাসিনোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। র‍্যাব অভিযান চালিয়েছে ১৮ টি এবং পুলেশের অভিযান হয়েছে ১৭টি সর্বমোট ৩৫টি। অভিযানের স্থানগুলো হচ্ছে, ২১টি ক্লাব, ৫তি বার। আ.লীগ ও যুব লীগের ৪ নেতার বাড়ি। এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে, মদের অসংখ্য বোতল, বিয়ার, ক্যাসিনো কয়েন।

ক্লাব, বার, বাসা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে ৭ কোটি টাকা ২৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, ১১টি অস্ত্র, ৭২০ ভরি সোনা, ১৬৫ কোতি টাকার এফডিএর, ৯ হাজার ডলার, ৭৫২ সিঙ্গাপুরি ডলার, ৫ লাখ টাকা মূল্যের মার্কিন ডলার, ২০ হাজার টাকার জাল নোট। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকায় ২১৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ৫৩ জন। বড় মাপের চারজন গ্রেপ্তার হলেও বিতর্কিত অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে যদিও এই অভিযান চলমান রয়েছে এবং র‍্যাবকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি চট্টগ্রামেও অভিযান পরিচালনা হয়েছে মোহামেডান স্পোর্টিং , আবাহনী লিমিটিডে যদিও এখানে তাস ছাড়া তেমন কিছু উদ্ধার হয়নি। তবে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে আবাহনী লিমিটেডের সভাপতি জাতীয় সংসদের হুইপ পটিয়ার সংসদ সদস্য এই অভিযানের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যদিও চট্টগ্রামের সরকারি দলের অন্যান্য নেতারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে তাঁদের একাত্মত্তা প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে ক্যাসিনো সম্রাট ইসমাইল হোসেন সম্রাটের হাতেও পড়েছে হাতকড়া।

রাজনীতি এক সময় ছিল ত্যাগী নেতা কর্মীদের, শিক্ষিত, মার্জিত ভদ্র এবং আইনপেশায় নিয়োজিত আইনবিদদের হাতে। এবং এরাই জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে মনোনীত হতেন এবং জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সেনা শাসক জেনারেল জিয়া বলেছিলেন – মানি ইজ নও প্রবলেম এবং আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবো। বার বার সামরিক শাসনের ফলে প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন জাতীয় সংসদ এবং রাজনীতি ক্রমশ ধনী এবং ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে। ঠিক একইভাবে ক্রীড়াঙ্গনও ধনী এবং বিত্তবানদের হতে চলে গেছে। রাজনীতির মতো ক্রীড়াঙ্গনকে এরা টাকা কামানোর হাতিয়ার বানিয়ে ফেলেছে। ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি এবং ক্ষমতার  মোহ এবং মন-মানসিকতার কারণে হারিয়ে গেছে ক্লাবগুলোর ঐতিহ্য, হারিয়ে গেছে খেলার মান। হারিয়ে গেছে খেলা নিয়ে মানুষের আনন্দ উচ্ছ্বাস উন্মাদনা। কমে গেছে খেলাধুলার প্রতি মানুষের টান।

 খেলাধুলাও যে মানুষের আনন্দ আর বিনোদনের প্রাণ তাও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ক্লাবগুলো ছিল শুধু খেলা কেন্দ্রিক।  জুয়ার টাকায় জৌলুশ বেড়েছে কমেছে খেলায় মনোযোগ।  ক্রীড়াঙ্গনের যে ক্লাবগুলো এককালে ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল সহ নানান ধরণের খেলা দাপটের সঙ্গে খেলার মাঠ কাঁপিয়ে খেলেছে সেসব ক্লাবগুলোর অফিসে এখন সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বসে জমজমাট ক্যাসিনোর আসর। জুয়ার আসর, মদের আসর, মাদক সেবনসহ নানান অনৈতিক অশ্লীল কর্মকাণ্ড।

জানা যায় ঢাকায় এ ধরণের ৬০ টি ছোট বড় ক্যাসিনো বা জুয়ার আড্ডা রয়েছে। এসব অপকর্ম থেকে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনও কম নয়। চট্টগ্রামে অভিযান চালানোর পরে বুঝা যাবে আসল চিত্র। যদিও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামে দৈনিক ৪০ লাখ টাকার লেনদেন হয়ে থাকে।

ক্রীড়াঙ্গন থেকে এই অশুভ চক্রকে প্রতিহত করতে হলে, ক্যাসিনো বা জুয়ার আসর বন্ধের জন্য অনতিবিলম্বে ত্যাগী সংঘটক, খেলোয়াড় দের নিয়ে কমিটি করার পাশাপাশি আগের বা পুরানো পরীক্ষিত সংঘটকদের এনে নতুন করে ক্লাব পুনর্ঘটন করা জরুরী। আর্থিক অনুদান, সরকারী ও বেসরকারি সাহায্য, সরকারী অনুদান দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনকে জঞ্জাল এবং কলুষমুক্ত করা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। 

বিভিন্ন খেলায় এবং ক্লাবগুলোকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা বা স্পন্সর করার জন্য দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গ্রুপ, কর্পোরেট হাউস, ব্যবসায়ী এবং ধনাঢ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দেয়ার জন্য।  সুস্থ সবল জাতি গঠনের জন্য এবং আনন্দ ও বিনোদনের জন্য জাতির সামনে খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই।

তাই এসব ক্ষেত্রে প্রদত্ত অর্থ বিনিয়োগকারীদের আয়করে ছাড় দেয়ার ব্যাপারে সরকারকে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে হবে। পাশাপাশি এসব ক্লাব গুলো আয়ের জন্য কি কি করতে পারবে বা করতে পারবে না সে বিষয়ে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন বা নীতিমালা তৈরি করা সরকার এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে উঠেছে।  আমরা খেলার মাঠের খেলা দেখতে চাই। চাইনা রাতের আঁধারে ক্লাবের অভ্যন্তরে মদ, নেশার আড্ডা এবং ক্যাসিনো বা জুয়া খেলা।

মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী 

লেখক ও কলামিস্ট

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। আমার কক্সবাজার অনলাইন এবং আমার কক্সবাজার-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)