৬১২ মিনিট আগের আপডেট; দিন ৯:৩০; শুক্রবার ; ১৮ এপ্রিল ২০২৪

মারিয়া সালামের শারদীয়া গল্প ‘আবাহন’

মারিয়া সালাম ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ১৪:৩২

প্রতিমা থানে উঠতে আর দেরী নাই, রাত পোহালেই হবে দূর্গা বরণ। গলির মাথার মন্ডপে পুরোদমে কাজ চলছে। অজন্তা এই পথে রোজকার মতো আজও ওড়নায় মুখখানা ভালো করে আড়াল করে মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছে।

এই এলাকায় ও উঠেছে তাও বছর ঘুরে এল। নতুন নাম নিয়েছে জুলেখা। এই দেশে একা একটা মেয়েকে কেউ ঘর ভাড়া দিতে চায় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গলির ভেতরে স্যাঁতস্যাঁতে একটা রুমে সে উঠতে পেরেছে। যদিও ভাড়াটা বেশি, তবুও মাথা গোঁজার ঠাঁই বলে কথা, অজন্তা এককথায় রাজি হয়ে গেছে।

পাড়ার বাচ্চাদের পড়িয়ে আর পাশের মহল্লায় নতুন কলম ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করে যা পাচ্ছে, বেশ টেনেটুনে চলে যাচ্ছে। যদিও মাসের শুরুর দিকের এই সময়টাতে খুব টানাটানি চলে।

ছাত্রছাত্রীরা বেশিরভাগ ই দরিদ্র পরিবারের, তাদের বেতন পেতে পেতে মাসের পনের তারিখ। তাতে ওর খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন, পূজা বলে কথা। অজন্তার অনেকদিনের শখ ঘরে ঠাকুরের প্রতিমা নিয়ে আসবে, সেটা এই মুসলমান পরিচয়ে সম্ভব না। তবে, কিছু না হলেও একটা লালপেড়ে শাড়ি অন্তত নেয়া দরকার৷ এবার সেটাও হবে না বলে মনে হচ্ছে।

কতদিন পূজার সময় মন্ডপে যাওয়া হয় না, কতদিন নাড়ু, মুরকি খায় না ও। এই সময়টাতে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে অজন্তার। অনেক ইচ্ছা করে লালপাড় শাড়ি পরে মন্ডপে মন্ডপে ঘুরবে, ঠাকুরকে প্রনাম করবে। এখন সেসব দূরে থাক, দূর থেকেও ঠাকুর দেখতে ভয় হয়। এখনতো ও অজন্তা না, এখন ও জুলেখা, মুসলমানের পরিচয়ে এপাড়ায় উঠেছে।

এছাড়া ওর আর কিছুই করার ছিল না, অনেক কষ্টে এই পরিচয় পত্রটাই জোগাড় করা গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, হাজার পাঁচেক টাকা ঢেলে তবেই মিলেছে পরিচয়পত্র।

মফস্বলের উচ্চবংশের মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে জন্ম অজন্তার। বাবা-মায়ের শখ ছিল মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে বড় করবে। অজন্তাও পড়ালেখাতে বেশ ভালোই ছিল, সাথে খেলাধুলাতেও কম যেত না। বাবা-মায়ের আহ্লাদে বেশ একরোখাও হয়ে উঠেছিল বটে।

মফস্বলের এইসব পরিবারগুলোতে মেয়েদের ম্যাট্রিক পাশ যথেষ্ট। তারপরেই ভালো পাত্র খুঁজে বিয়ে। এইসব এলাকায় কেউ মেয়েকে শিক্ষিত করতে চায় না বললেই চলে।

মেয়েকে এরকম ঘরে বসিয়ে রেখে পড়ানোর জন্য অজন্তার বাবা-মাকেও কম কথা শুনতে হয়নি প্রতিবেশীদের কাছে। মুখ বাঁকিয়ে অনেকেই বলেছে, ওরাতো মেয়েকে ঝাঁসির রাণী বানাবে।

অজন্তা নিজেও তাই হতে চেয়েছিল, ঝাঁসির রাণীর মতো সাহসী। সেভাবেই শক্ত হাতে ভাঙতে চেয়েছিল সমাজের গড়ে দেয়া ফালতু সব ধ্যানধারণা। ঝাঁসির রাণী হবে বলেই, জাতপাতের তোয়াক্কা না করে ভালোবেসেছিল দেবেশকে।

দেবেশরা ওদের মতো উচ্চবংশীয় না। ব্যাপারটা জানাজানি হলে বিরাট ঝামেলা হয়ে যাবে, খুনখারাবিও হতে পারে। সেই ভয়েই কলেজের গন্ডি না পার হওয়া অজন্তা একদিন দেবেশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল। সে এগারো বছর আগের কথা। তখন অজন্তার ছিল বড়জোর সতের বছর, এখন চলছে আটাশ।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই গলির মোড়ের মন্ডপের সামনে এসে রোজকার মতো একটু দাঁড়ালো অজন্তা। ঘর থেকে বের হয়ে এটুকু আসতেই ওর হাফ ধরে, তার উপরে বেশ গরম পড়েছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে কড়া রোদ। এখানে সেই বৃটিশ যুগের একটা ঢোপকল আছে, অজন্তা ব্যাগ থেকে খালি বোতল বের করে পানি পুরে আবার ব্যাগে রাখে।

ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে সামনে এগোতেই ওর চোখ আটকে যায় ঢোপকল আর ড্রেনের গাঘেষে ময়লা ফেলার জায়গাটার কাছে। সাত-আট বছর বয়সি একটা মেয়েকে শুইয়ে রাখা হয়েছে রাস্তায় চট পেতে। মেয়েটার নড়াচড়া করার ক্ষমতা নাই। গায়ে কোন কাপড়ও নাই, একটা কাপড়ের প্যান্ট পরা কেবল। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে এদিক সেদিক দেখছে। এই কড়া রোদে কেবল অর্ধেক শরীর দেয়ালের ছায়ায়, উরু থেকে পা অবধি কড়া রোদে পুড়ছে মেয়েটার।

এদিক সেদিক তাকিয়ে মেয়েটার সাথে কেউ আছে কিনা বুঝার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নিজেই চটের মাথা ধরে মেয়েটাকে মন্ডপের কাছে ছায়ায় টেনে এনে রাখল। বোতল থেকে পানি খাওয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল আলতো করে।

এতদিন এপাড়ায় আছে, একে এর আগে কোনদিন দেখেনি অজন্তা। মনে মনে ভাবল, দেবী থানেই উঠলো না এরা চুক্তিতে এখন থেকেই ভিক্ষুক বসানো শুরু করে দিয়েছে। যদিও বহুবছর পূজাপার্বণে ওকে ঐ ছোট্ট ঘরটার মধ্যেই নিজেকে কাটিয়ে দিতে হয়েছে, তারপরেও পূজাকমিটির এইসব বানিজ্যে ও বরাবরের মতোই বিরক্ত। আরেকবার বিরক্তি নিয়ে মেয়েটাকে দেখল অজন্তা, অমনি ওকে অবাক করে হেসে উঠল মেয়েটা।

হা ভাগবান, এইভাবে রোদের মধ্যে ড্রেনের পাশে শুয়েও তুই এমন হাসতে শিখলি কিভাবে? প্রশ্নটা করে উত্তরের অপেক্ষা করতে হলো না ওকে, তার আগেই বুঝে গেল মেয়েটা কথাও বলতে পারে না। নিজের অজান্তেই চোখে পানি এসে গেল ওর, মেয়েটার মাথায় আবার হাত বুলিয়ে নিজের পথে হাঁটা দিল। ফ্যাক্টরিতে পৌছাতে হবে বেলা এগারোটার মধ্যেই।

বুকের ভিতর থেকে লম্বা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর। মনে মনে ভাবল, আমার চেয়েও ঢের বেশি কষ্টে আছে কেউ কেউ। নিজের জীবন নিয়ে আবার একবার ভাবতে শুরু করল অজন্তা।

ঝাঁসির রাণী হতে চেয়েছিল বলেই হয়তো সমাজের নিয়ম ভেঙে দেবেশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল, অনেক সাহসী কাজ করেছে ও, নিজের জন্য খুব ভালো লাগতো ওর। নিজের ভুল বুঝতে পারে একমাসের মাথায়, যখন দেবেশ ওকে একা ফেলে লাপাত্তা হয়।

বাড়ি ফিরে যাবার পথ খোলা ছিলনা অজন্তার। সত্যিকার জীবনযুদ্ধের পাঠ তখনই হয় ওর। বুঝতে পারে, সত্যিকার ঝাঁসির রাণী হবার মানে। জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে কিছু হয় না, নিয়ম পাল্টাতে চাইলে বরং নিয়মের ভেতরে থেকেই সেটা পালটে ফেলতে হয়। বাড়ি না পালিয়ে সমাজের এই ভেদাভেদ যদি দূর করতে পারতো সেটাই হয়তো সত্যিকার সাহসের কাজ হতো।

এই বুঝ সে বুঝেছে যখন জুলেখা নাম নিয়ে একা একা পথ চলা শুরু করেছে তারও বেশ পরে। মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবে জীবনটা আবার নতুন করে শুরু করার সুযোগ হলে ঠিকঠাক ঝাঁসির রাণী হয়ে উঠবে ও।

বিকেলে ঘরে ফেরার সময় অজন্তা দেখলো মেয়েটা এখনও সেভাবেই পড়ে আছে পথে। সারাদিনের ধকলে খুব নেতিয়ে গিয়েছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সকালে যেরকম হাসিমুখ ছিল, এখন সেরকম না, কেবল কেঁদে চলেছে। চোখের নীচের কালি আর ভেতরে ঢুকে যাওয়া পেট দেখে অজন্তার বুঝতে বাকি নেই, সকাল থেকেই বাচ্চাটা অভুক্ত।

পূজা কমিটির লোকদের উপরে খুব রাগ হচ্ছে ওর। তবে রাগ দেখানোর আগে জরুরি বাচ্চাটাকে কিছু খেতে দেয়া। মুদির দোকানে কলা আর পাউরুটি কেনার সময় জানতে চাইলো, ভাই এই বাচ্চাটার সাথে কাউকে দেখেছেন?

না, সকালে দোকান খোলার পর থেকেই দেখছি পরে আছে এখানে, সাথে কাউকে তো দেখি নি, মুদির কথায় খুব রাগ হচ্ছিল অজন্তার। কথা না বাড়িয়ে খাবার নিয়ে ছুটলো বাচ্চাটাকে আগে খাওয়াবে বলে। ঠিক করলো যা আছে কপালে পূজা কমিটির লোকদের সাথে আজ কথা বলেই ছাড়বে।

রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। অজন্তা ঠাঁই মেয়েটির কাছে বসা, কারো কোন খবর নাই। পূজা কমিটির লোকেরা বলেছে, তারা এর ব্যাপারে কিছুই জানে না। অজন্তার এখন এরপাশে বসে স্বজনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় নাই।

রাত এগারোটা বেজে গেল, কারো দেখা নাই। বাধ্য হয়ে অজন্তা উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটা সারাদিন বাদে খাবার পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। অজন্তা ঘরে ফেরার আগে নাইট গার্ডকে বারবার অনুনয় করে বলে এসেছে, মেয়েটির কাছে কেউ এলে ওকে যেন শেষ খবরাখবর অবশ্যই জানানো হয়।

সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরেও চিন্তা আর মন খারাপের জন্য অনেকক্ষণ জেগে রইলো অজন্তা। মেয়েটা কোথায় থেকে আসল? কারা রেখে গেল? এভাবে রাস্তায় একা ফেলে আসা ঠিক হল কিনা? মা বলত, দেবী কার কাছে কি রুপে ধরা দেয় বলা মুস্কিল। তাই, জীবে সেবা করতে হবে, জীব ঈশ্বরের রুপ। মেয়েটাকে রাতে পথে না রেখে ঘরে আনতে পারত অজন্তা।

এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুম আসল বেশ রাতে। ঘুমটা কিছুটা গাঢ় হয়েছিল, তখনই হঠাৎ বাড়ির উঠানে বেশ একটা হৈচৈ শুনে চোখটা খুলে গেল ওর। ধড়ফড় করে উঠে এতটাই হতবিহবল হয়ে গেছে, বাতি জ্বালানো র কথাই ভুলে গেছে। অন্ধকারে দেয়াল হাতড়ে দরজাটা খুলেই দেখে সেই নাইট গার্ডকে ঘিরে উঠানে বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের জটলা।

অজন্তাকে দেখেই লোকটা বলে উঠল, এই যে আপা, ঐ মেয়ের কাছে তো কেউ আসে নি সারারাত। মেয়ের ঘুম ভেঙেছে একটু আগে তখন থেকে কেবলই কেঁদে চলেছে। উপায় না দেখে আপনাকে ডাকতে এসেছি।

কয়েক সেকেণ্ড স্থির দাঁড়িয়ে থেকে অজন্তা খালি পায়েই এক দৌড়ে গলির মাথায় এসে মেয়েটির পাশে বসে পড়ল। ততক্ষণে আকাশের গা ফর্সা হয়ে আসছে। দেবীর থানে উঠার সময় হয়ে এল বুঝি, চারদিকে ঢাকের আর উলুর আওয়াজ ছাপিয়ে অজন্তা চিৎকার করে মেয়েটাকে বলল, ঝাঁসির রাণী হবি?

বর্ষা মঙ্গল
চোখ মেলতেই লাবণ্য দেখলো ঝুম বৃষ্টি এই ছোট্ট শহরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ ভ্রমণের পথে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, নিজেই বুঝেনি।

ওর গাড়ি একশ কিলোমিটার স্পিডে দুই টিলার মাঝখানের আধা ক্ষয়ে যাওয়া এবড়োখেবড়ো রাস্তার বুক চিড়ে ঢাকার দিকে ছুটছে। হঠাৎ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগাতেই ঘুমটা ভেঙে গেছে ওর। চোখ মেলেই অবাক হয়ে গেছে ও, শরতের এই সময়ে সামান্য বৃষ্টি অস্বাভাবিক তেমন কিছু না। কিন্তু, সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া এই বৃষ্টি!

লাবণ্য জানালার গ্লাস নামিয়ে হালকা করে মুখটা বাড়িয়ে দিল সামনে। বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর মুখ, চুল। পানিতে সিঁদুরের রঙ গলে কপাল চুইয়ে নাক অবধি এসে একবিন্দু জল হয়ে আটকে গেছে। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ড্রাইভারের দিকে লাজুক মুখে তাকিয়ে বলল, ওহ ভেতরের সব ভিজে যাচ্ছে না?

ড্রাইভার ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিল, শেষে পানি পড়ে জানালার গ্লাস জ্যাম হয়ে গেলে আরেক বিপদ। লাবণ্য দ্রুত গ্লাস উঠিয়ে আবার সিটের উপরে নিজেকে ছেড়ে দিল।

কি অদ্ভুত সুন্দর বৃষ্টি, হ্যাঁ, এরকম বৃষ্টিইতো সে ভালবাসতো, পৃথিবীর সব পাগলামী এরকম দিনেই তাকে পেয়ে বসতো। সবচেয়ে বড় পাগলামীটা ছিল, এরকম একটা দিনেই হুটহাট বিয়ে করে ফেলা।

লাবণ্য যেদিন বিয়ে করে ওর পরনে হালকা পিচ রঙের একটা সালোয়ার কামিজ, কামিজের নিচের দিকের সেলাই কিছুটা খুলে গেছে, ওড়নাটাও একঘেয়ে জলপাই রঙের। সে একমনে ফাঁকা ক্লাসরুমে বসে কবিতা আউড়ে চলছিল। প্লাবন এসে কথাবার্তা নাই, ওকে টেনে বের করে বলেছিল, তোর না শখ ঝুম বৃষ্টির দিনে বিয়ে করা, চল আজকেই বিয়ে করে ফেলি।

কিন্তু, আমার হাতে একদম কোন টাকা পয়সা নাই, ব্যাগে মাত্র পাঁচ টাকার একটা কয়েন, আর কাপড়ের হাল দেখেছিস? লাবণ্যের কথার জবাবে, প্লাবন পাল্টা কিছুই বলে নি। কেবল ওকে টেনে একটা রিক্সায় তুলেছে।

লাবণ্য মনে মনে হাসে, প্রথম প্রথম এইসব দিনে সে দু’জনের জন্য কতো আয়োজন করে কতোসব প্ল্যান করতো। সেইসব এখন ঝাপসা স্মৃতি।

যার জন্য এত আয়োজন হতো সে এসব দিনে কি ভাবে, লাবণ্য সেসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না একদম। এরকম কতো বর্ষার দিনগুলো সে নিজেই কাটিয়ে দেয় ঘুমিয়ে অথবা ঘরে ফিরে দীর্ঘসব ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে।

ফেসবুকের টুংটাং নোটিফিকেশনের শব্দে ওর চিন্তায় ছেদ পড়ে। ফেসবুক ওপেন করতেই খবরটা চোখে পড়ে: পূজার মন্ডপের ঢোকারমুখে কোন এক তরুণ তার প্রেমিকাকে চুমু দিচ্ছে। মন্ডপের বাইরে বৃষ্টির তোড়ে তাদের চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পেছনে কেবল দেবী প্রতিমার ঝাপসা অবয়ব বলে দিচ্ছে এটা একটা পূজা মন্ডপের সামনেই।

এই নিয়ে ফেসবুকের দেয়াল ভেসে যাচ্ছে নানা মতামতে। কারো ভালো লেগেছে, কারো মোটেই না, কেউ বলছে, কলিকালে এমন অনেক কিছুই দেখতে হবে।

সবচেয়ে লেগেছে যারা নিজেদের ভগবানের লাঠিয়াল হিসেবে ভেবে নিয়েছে তাদের। তারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই হন্যে হয়ে ফটোগ্রাফারকে খুঁজে বেড়াচ্ছে উচিত শিক্ষা দিবে বলে। নিজের মনেই হেসে ফেলল লাবণ্য।

ক্লান্তহাতে মোবাইল ফোনটা সিটের উপরে ছুঁড়ে দিতে দিতে নিজেই মনে মনে বলল: এই প্রেমহীন এই নাগরিক জীবনে একটা চুম্বনের ছবি কতো সহজেই ভাইরাল হয়ে যায়!

জামার ডানা

অবিনীতা বাড়িতে ঢুকতেই রক্তিম ওর হাত ধরে টানতে টানতে শোবার ঘরে নিয়ে এল। অবাক অবিনীতা চোখের ইশারায় জানতে চাইলো, কি হয়েছে?

রক্তিম ফিসফিস করে বলল, তোমাদের বাড়ি থেকে কাজের লোক পাঠানোর কথা ছিল?

হ্যা, কেন কি হয়েছে তাতে?

মায়ের সেই মেয়ে একদম পছন্দ না। খুব ক্ষেপে আছে। তোমাকে কিছু বললে তুমি আবার মুখে মুখে উত্তর দিও না। পূজাপার্বণের দিন, বাড়িতে যেন অশান্তি না হয়।

একে তো বাইরে প্রচন্ড গরম, তারপরে পূজার বাজারে যা ভীড়, এমনিতেই অবিনীতার মাথা গরম, তারপরে এই সব শুনে খুব রাগ উঠে যাচ্ছে ওর। গলা চড়াতে যাবে, ঠিক তখনই রক্তিমের মা এসে হাজির।

নীতা তোমাদের বাড়ির লোকেদের মাথামুন্ডু কি ঠিক নাই। এরকম অনার্য্য দেখতে একটা মেয়ে পাঠিয়েছে। এর হাতে আমি কিছু খাব বলে তোমাদের মনে হয়? তোমরা কি আমাদের আন্ডারএস্টিমেইট কর?

নীতার মুখে অনেক কথা এসে পড়েছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, মা ওকে আবার পাঠিয়ে দেন।

মুখে মুখে কথা বোলো না বাপু। সাক্ষাত মা কালীর মতো কাল আর এই দাঁতউঁচা মেয়ে আমি আমার বাড়ি রাখবো না। নেহাতই কাল মহালয়া বলে রেখে দিলাম। দেবী বিসর্জনের পরেই ওকে তোমাদের বাড়িতে রেখে আসবে।

অবিনীতা আর কথা বাড়ায় না। চোখেমুখে ক্ষোভ নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে দেখে বার বা তের বছরের এক কিশোরী মেঝেতে জড়োসড় হয়ে বসে আছে। অবিনীতাকে দেখে একটু আশ্বস্ত হলো বুঝি, মিষ্টি করে হেসে প্রনাম করতে আসল।

থাক থাক, লাগবে না, কি নাম তোমার?

আমার নাম কাকলী।

বাড়িতে কে আছে?

মা মরে গেছে, বড়দির বিয়ে হয়েছে। বাবা আবার বিয়ে করেছে। তাই, আমার জায়গা নেই বাড়িতে। বাবা চাইলেই আমাকে খাওয়াতে পড়াতে পারে মামী, কিন্তু দিবে না। মা মরলে জগতে আর কেউ থাকে না গো মামী।

অবিনীতা এই জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অনেকটা ইতস্তত করেই বলে ফেলল, আমি আছি না, এখন তোমার কোন চিন্তা নাই।

সকালে রান্নার ফাঁকে অবিনীতা কাকলীর সাথে টুকটাক আলাপ চালিয়ে গেল। আচ্ছা, এবার পূজায় তোকে কি দিব বল?

মামী, আমাকে একটা লাল জামা দিও। আর কিছু লাগবে না, টকটকে লাল জামা।

আচ্ছা দিব, সাথে লাল স্যান্ডেল আর চুড়ি, কি বলিস?

শাশুড়ি মা এতক্ষণ মুখ গোমরা করে একমনে রেঁধে যাচ্ছিল। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলো না, নীতা, তোমার মায়ের বাড়ির দেয়া লোক বলে এত আদিখ্যেতা দেখানোর কোন মানে নাই। এরকম রাবনের মতো গায়ের রঙ, তারপরে পরবে লাল জামা!

অবিনীতা লজ্জায় চোখ নামিয়ে একমনে কাজ করে গেল, কাকলীর দিকে তাকানোর সাহস হলো না ওর।

ষষ্ঠীর আগের রাতে বাড়ি পরিস্কার করে, রান্না করে অবিনীতার স্নান করতে করতে ভোর চারটা বেজে গেল। ওর ক্লান্তি দেখে কাকলী বলল, মামী তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি স্নান সেরে সকালের সব ঠিকমতো গুছিয়ে রেখে তারপরে কি লালজামাটা পরব?

সে কিরে, সেটা তো পরবি বিজয়ার দিনে।

না, না, আমি আজকেই পরব, প্রতিদিন এটাই পরে যাব ঠাকুর দেখতে।

অবিনীতা নিজের মনেই হাসতে হাসতে ঘুমাতে গেল। ঘন্টা দুয়েক বাদেই বিকট চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভাঙল। তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বের হয়েই দেখে কাকলী বাথরুমের দরজায় ঢিট দাঁড়িয়ে, গায়ে ভেজা কাপড়। পাশেই লালজামাটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর ঝাড়ু হাতে শাশুড়ি মা দাঁড়িয়ে সমানে চিল্লে যাচ্ছে, তুই এক্ষুনি এইমূহুর্তে আমার বাড়ি থেকে বিদায় হবি। যার সাহসে আমার মুখের উপরে কথা বলিস, তার বাপের বাড়ি গিয়ে উঠ। ওরা তোকে একবেলা ভাত খাওয়াবে সেই উপায় ওদের নাই। যা গিয়ে ওদের সাথেই উপোস করে থাক।

মা, আপনি এসব বলার জন্য আজকের দিন বেছে নিলেন? কি হয়েছে?

কি হয়েছে? সব শিখিয়ে দিয়ে এখন বলছ কি হয়েছে? তোমার সাহসেই ও দাসী, ঝিয়ের ঘরের ঝি আমাকে বলে তোমার কথা শুনে কাজ নেই, মামী কিনে দিয়েছে, আমি আজকেই লাল জামা পরব।

তোর মামী কি বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে তোকে জামা কিনে দিয়েছে? আমার ছেলের টাকায় কেনা জামা, বলতে বলতেই কাকলীর গায়ে ঝাড়ুর বাড়ি বসিয়ে দিলেন শাশুড়িমা।

রক্তিম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নিজের মনেই বলে চলেছে, মা আজ বাড়াবাড়িটা বেশি হচ্ছে। আওয়াজ এতই ক্ষীণ যে মায়ের কানে সেটা যাচ্ছে না।

অবিনীতা বাড়িতে ফোন করে বলেছে কাকলীকে নিয়ে যেতে। ঘন্টাখানেক বাদেই অবিনীতার মামা এসে কাকলীকে নিয়ে গেল। যাবার সময়ও মেয়েটার গায়ে ভেজা আর পুরানো জামাটা ছিল। অবিনীতা ব্যস্ত হাতে একটা ব্যাগে নিজের পুরানো কিছু কাপড় আর পাঁচশোটা টাকা দিয়ে বলেছিল, ভালো থাকিস।

কাকলী করুণ চোখে তাকিয়ে বলেছিল, মামী, দিদিমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলে কি আমার জামাটা ফেরত পাব? অবিনীতা কিছু জবাব দিতে পারে নি। কান্না আটকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে একদৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লক করে দিল।

ও যখন ঘর ছেড়ে বের হলো তখন সন্ধ্যা নামছে কেবল। অবিনীতা বিষন্নমনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা লাল আভা ওকে কাকলী কথা আবার মনে করিয়ে দিল। চোখ বেয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়া অশ্রু হাতের উলটা পাশ দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, ভালো থাকিস কাকলী। পাশের রশিতে তখনও লাল জামাটা বাতাসে দুলছে, যেন ডানা মেলে এখনই আকাশে উড়ে যাবে।

মারিয়া সালাম
লেখক ও সাংবাদিক